top of page

শিল্পকলায় সন্ত্রাস ও সংহতি (প্রবন্ধ)

লেখক : মৃণাল ঘোষ

প্রকাশক : ভিরাসত পাবলিকেশন

 

 

দৈর্ঘ্য : ২৪০ মিমি

প্রস্থ : ১৮৮ মিমি

স্পাইন : ২১ মিমি

পৃষ্ঠা : ২৬০

 

প্রকাশকের কথা

শিল্পকলায় সন্ত্রাস ও সংহতি-র বিষয়টি একসাথে পাশাপাশি থাকলে আলাদা কৌতূহল তৈরি হয়। এই বইটির নাম দর্শনে পাঠকের সেই অনুভূতিই হবার কথা। কিন্তু প্রশ্ন হল মলাট উলটোবার পরে বইটি তার উপাদানে কতটুকু সমৃদ্ধ, এই জটিল বিষয়টিকে ঠিকমতো উপস্থাপন করতে পেরছে কি-না— তার উত্তর পাওয়া জরুরি হয়ে ওঠে। বহুক্ষেত্রে দেখা যায় লেখক কিছু ওপর ওপর তথ্য সাজিয়ে ক্ষান্ত হয়েছেন! এসবের কী, কেন তার ব্যাখ্যা বা যুক্তিপূর্ণ বিশ্লেষণ করেননি। মৃণাল ঘোষ প্রাজ্ঞ ও অভিজ্ঞ কলা বিশারদ হওয়া সত্ত্বেও পাণ্ডুলিপি পড়ার আগে পর্যন্ত আমি নিশ্চিত হতে পারছিলাম না বইয়ের সার-অসার সম্পর্কে। পাণ্ডুলিপি পড়ে আমার এই প্রত্যয় অর্জন হয়েছে যে মৃণালবাবুর রচিত বহু গ্রন্থ-এর যার কয়েকটি এই প্রকাশনা জাত, মধ্যে এই বইটি বাংলাভাষী শিল্পী ও শিল্প প্রেমী বন্ধুদের কাছে দীর্ঘ সময়ের জন্য একটি মূল্যবান বই হিসেবে টিকে থাকবে। বিশেষ করে পুঁজিবাদ, ফ্যাসিবাদ তথা সর্বোপরি সাম্রাজ্যবাদী প্রক্রিয়ায় বিরুদ্ধে বিশ্বময় শিল্পীদের সাহসী প্রতিবাদের প্রতিবেদন রূপে এই বইটি যুগ যুগ ধরে পাঠকের কাছে মানবসভ্যতার ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিককে উন্মোচন করবে এবং প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। সন্ত্রাস ও সংহতির প্রসঙ্গকে তিনি পরিপূরক আঙ্গিকে চমৎকারভাবে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন। পিকাসো থেকে গণেশ পাইন— ছবিকে হাতিয়ার করে মানুষের উত্তরণের আখ্যান এই গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য। আমি কৃতজ্ঞতা জানাই লেখককে যে তিনি আমার ওপর ভরসা করে এই বইটি পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছেন। প্রচ্ছদ শিল্পী পার্থ প্রতিম রায়-সহ নির্মাণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী সকলের প্রতিও আমার নির্ভেজাল কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলাম।

 

গণেশপ্রতাপ সিং

(প্রকাশক)

 

 

গ্রন্থ প্রসঙ্গ


তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত ষোলটি প্রবন্ধের সংকলন এই বই—“শিল্পকলায় সন্ত্রাস ও সংহতি।” পর্যায়গুলি হল : এক,  সন্ত্রাস; দুই, সংহতি; তিন, সমন্বয়। প্রতিটি আলোচনাই স্বতন্ত্র প্রবন্ধ হিসেবে লেখা হয়েছে, যদিও কোনো-কোনো বিষয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে বেশ কিছু নিবন্ধে। কিন্তু মজার বিষয়টি হল, কোনও লেখা থেকে সেই পুনরাবৃত্ত অংশটি বাদ দিলে প্রবন্ধের লেখাটির সংহতি সম্পূর্ণ বিঘ্নিত হতো।

শিল্পের প্রকাশে সাধারণত দুটি অভিমুখ থাকে। একটি প্রতিবাদী। আরেকটি ধ্রুপদী। লেখকের ‘এই সময়ের ছবি’-তে এই দ্বিতীয় ধারার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘সমন্বিত রূপকল্প'। জীবনে বা প্রকৃতিতে নানা অসঙ্গতির মধ্য দিয়ে চলতে হয় মানুষকে। অজস্র দুঃখ বহন করতে হয়। কিছু দুঃখ তাঁর অস্তিত্ব-সঞ্জাত। কিছু দুঃখ আরোপিত, তা আসে সামাজিক পরিকাঠামোর হিংসা, সন্ত্রাস ও অনিয়ম থেকে। শিল্পের একটি ধারায় এইসব অসঙ্গতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়। এই প্রতিবাদ অনেক সময়ই রোমান্টিক চেতনা সঞ্জাত। এর পাশাপাশি প্রবাহিত হয় এক সংহতি ও সমন্বয়ের সুর। জীবনের যে-অসম্পূর্ণতা তার বিপরীতে শিল্পী মেলে ধরতে চান সৌন্দর্য ও পূর্ণতার জগৎ। ধ্রুপদী শিল্পে এই আধ্যাত্মিক পূর্ণতার পরিমণ্ডল উদ্ভাসিত করতে চান শিল্পী। এই যে দুই বিপরীত প্রবাহ, এরই কিছু কিছু দিক অনুধাবনের প্রয়াস রয়েছে এই লেখাগুলোতে। এর ভিতর থেকে উঠে এসেছে শিল্প-ইতিহাসের নানা অনুষঙ্গ।

প্রথম পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে পাঁচটি আলোচনা, যার সবই জীবনের দুঃখ বা অসঙ্গতি সঞ্জাত। প্রথম প্রবন্ধ ‘১৯৪৩-এর মন্বন্তর ও বাংলার চিত্রকলা’। এই মন্বন্তরের মূল কারণ ছিল ঔপনিবেশিক সরকারের নির্দয় সন্ত্রাস। মানুষের উপর যে-দুর্দশা নেমে এসেছিল, তা ব্যথিত করেছে শিল্পীদের। সেই দুঃখ থেকে তাঁরা গড়ে তুলেছেন প্রতিবাদের শিল্পকলা। ঔপনিবেশিক পরিস্থিতি ও অন্যান্য নানা কারণে তৈরি হয়েছে যে-সাম্প্রদায়িক ঘৃণার পরিমণ্ডল, তা থেকে বার বারই জেগে উঠেছে সংঘাত বা দাঙ্গা। এই মর্মান্তিক পরিস্থিতিকে অনেক শিল্পী ধরতে চেয়েছেন তাঁদের ছবিতে। সেটাই দ্বিতীয় আলোচনার বিষয়। এরপর বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে সারা বিশ্বের যুদ্ধবিরোধী শিল্পকলা নিয়ে। সামগ্রিক দুর্যোগ থেকে গড়ে ওঠে এক ধরনের নৈরাশ্যের চিত্রকলা। সম্প্রতিকালে অতিমারির পরিস্থিতিতে  এর বহু নিদর্শন দেখা গিয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই লেখা হয়েছে চতুর্থ প্রবন্ধ ‘দুর্যোগের কাল ও নৈরাশ্যের চিত্রকলা’। শিল্পী সোমনাথ হোরের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার রাখা হয়েছে এই পর্যায়েই। কেন-না তাঁর কাজে আমরা দেখতে পাই বিশ্বব্যাপ্ত সামগ্রিক হিংসা ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ। সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছিল ১৯৯২ সালের ২৬ জানুয়ারি শান্তিনিকেতনে তাঁর ‘লাল বাঁধ’ গ্রামের বাড়িতে। এই পাঁচটি লেখা নিয়ে এই বইয়ের প্রথম পর্যায়।

দ্বিতীয় পর্যায় ‘সংহতি’। সেখানেও রয়েছে পাঁচটি আলোচনা। মার্কসবাদ সবসময়ই সংহতির কথা বলে। সংহতি আনার জন্যই সংগ্রাম, বিপ্লব। মার্কাসীয় শিল্পাদর্শ ঠিক কী, ভারতের আধুনিক শিল্পকলায় এর প্রকাশ কীভাবে ঘটেছে, সেটাই অনুধাবনের প্রয়াস ষষ্ঠ প্রবন্ধে। নব্য-ভারতীয় ঘরানা এক ধ্রুপদীচেতনার উৎসারণ ঘটিয়েছিল লৌকিক আর অলৌকিকের সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে। স্বদেশচেতনা-সঞ্জাত এই আন্দোলনের বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে অষ্টম অধ্যায়ে। তার আগে রয়েছে কলকাতার প্রাক-আধুনিক ও আধুনিক চিত্র ও ভাস্কর্য নিয়ে আলোচনা। সারা পৃথিবীর চিত্রকলায় নদী, জল ও সমুদ্রের রূপায়ণ কীভাবে ঘটেছে, নবম অধ্যায়ে সেটাই বোঝার চেষ্টা। দশম নিবন্ধটি একটু ভিন্ন ধারার। ছবির গভীরে থাকে এক ধরনের নাটকীয়তা। বিচিত্র তার চরিত্র। তার উপরেই আলোকপাতের চেষ্টা এই নিবন্ধে।

‘সংহতি’ আর ‘সমন্বয়’ প্রায় কাছাকাছি অর্থে অর্থান্বিত। তৃতীয় পর্যায়ের নাম দেওয়া হয়েছে ‘সমন্বয়’। ছ-জন ব্যক্তিশিল্পীর সৃজনের আলোচনা এখানে। ধ্রুপদী ও রোমান্টিক চেতনার সমন্বয় তাঁদের প্রায় সকলের কাজেই। রবীন্দ্রনাথ ও গগনেন্দ্রনাথের চিত্রসৃজন সমৃদ্ধ করেছে ১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশককে। নব্য-ভারতীয় ঘরানার আদর্শের বিপরীত বা ভিন্ন প্রান্তে তাঁদের অবস্থান। তাঁরাই আবার চল্লিশের দশকের প্রেরণাস্থল। চল্লিশের দুই ব্যতিক্রমী এবং অনেকটাই অনালোচিত শিল্পী নীরদ মজুমদার ও সুনীলমাধব সেন। সমন্বয় চেতনাই তাঁদের সৃজনের বৈশিষ্ট্য। চল্লিশের সাধারণ প্রবণতা যে-প্রতিবাদী চেতনা, এর বাইরে তাদের অবস্থান। ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ অধ্যায়ে তাঁদের নিয়ে আলোচনা। চল্লিশের আবহেই গড়ে উঠেছে সত্যজিৎ রায়ের শিল্পীসত্তাও। তাঁর সৃজনের নৈতিকতার আলোকে বোঝার চেষ্টা হয়েছে তাঁর ফলিত কলা ও চলচ্চিত্র। ষাটের দশকের প্রধান এক শিল্পী গণেশ পাইন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, পুরাণকল্প ও আধুনিক জীবন— এসবের দ্বান্দ্বিকতা ও সমন্বয় তাঁর ছবিতে। প্রখ্যাত ইটালীয় চলচ্চিত্রকার ফোলিনি-র ‘লা দোলচে ভিটা' ফিল্ম থেকে কীভাবে উৎসারিত হয়েছিল তাঁর ছবির একটি পর্যায়, তা নিয়েই আলোচনা ষোড়শ বা শেষ প্রবন্ধে।

সুতরাং শিল্প-নন্দন ও শিল্প-ইতিহাসের এক বিস্তৃত পরিমণ্ডল উঠে এসেছে এই ষোলটি নিবন্ধে। তা যদি কোনোভাবে পাঠককে আকৃষ্ট করে বা আগ্রহ জাগায়, তাহলেই এই প্রয়াসের সার্থকতা। মন্বন্তর সম্পর্কিত প্রথম আলোচনাটি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রেক্ষাগৃহে উপস্থাপিত হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন একটি সংস্থার আমন্ত্রণে। বইটি প্রকাশের দায়িত্ব নিয়ে কৃতজ্ঞতাভাজন হলেন 'ভিরাসাত আর্ট পাবলিকেশনস্’-এর কর্ণধার গণেশ প্রতাপ সিং ও কর্মাধক্ষ পার্থ রায়। এই বইয়ের প্রচ্ছদে নেওয়া হয়েছে সোমনাথ হোরের একটি ব্রোঞ্জভাস্কর্য, যার শিরোনাম ‘হোমেজ টু জাহানারা ইমাম’। জাহানারা ইমাম (১৯২৯-১৯৯৪) ছিলেন বাংলাদেশের একজন লেখিকা, শিক্ষিকা ও শিক্ষা-সংগঠক ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে তিনি তাঁর স্বামী ও পুত্রকে হারিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর পরে ১৯৯৪ সালেই সোমনাথ হোর এই ভাস্কর্যটি করেন। এর মধ্যে রয়েছে বিপর্যয় ও মানবিক করুণার এক সংহত রূপ।

প্রতিটি আলোচনাই স্বতন্ত্র প্রবন্ধ হিসেবে লেখা হয়েছে। তাই কোনো-কোনো বিষয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে একাধিক নিবন্ধে। কোনো লেখা থেকে পুনরাবৃত্ত অংশটি বাদ দিলে লেখাটির সংহতি বিঘ্নিত হতো।

 

লেখক পরিচিতি : শিল্পকলা বিষয়ে লেখার ক্ষেত্রে মৃণাল ঘোষ সুপরিচিত। এ-পর্যন্ত এ-বিষয়ে তাঁর প্রায় তিরিশটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে বা হতে যাচ্ছে। যাতে আমাদের দেশের ও সারা বিশ্বের শিল্পকলার নানা দিক তিনি তুলে ধরেছেন। এছাড়া ‘ব্যক্তিগত লেখামালা' নামে কবিতা-কেন্দ্রিক তেরোটি বইও এ-পর্যন্ত বেরিয়েছে তাঁর। জন্ম ১৯৪৪ সালের ১০ নভেম্বর তৎকালীন পূর্ববঙ্গে। দেশভাগের পর ছিন্নমূল হয়ে এ-দেশে চলে আসা ঔপনিবেশিকতাজনিত যে-সন্ত্রাস আমাদের দেশকে ছিন্নভিন্ন করেছে তাকে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছেন তিনি নিজের জীবনে। তা থেকেই গড়ে উঠেছে যে-বিশ্বদৃষ্টি, তারই প্রতিফলন তাঁর লেখালেখিতে।

Comments


bottom of page