top of page

কালের প্রবাহে বাংলাদেশ


সংকলন ও সম্পাদনা : মোস্তাফা হোসেইন, পার্থপ্রতিম রায়

প্রকাশক : ভিরাসত আর্ট পাবলিকেশন


দৈর্ঘ্য : ২১৯ মিমি

প্রস্থ : ১৪৩ মিমি

স্পাইন : ২৮ মিমি

পৃষ্ঠা : ৩৪৬



প্রকাশকের কথা

ভিয়েতনাম নিয়ে সাত-এর দশকে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মধ্যে যতোটা আবেগ লক্ষ করা যেত, সংগ্রামরত পূর্ব বাংলার মানুষের প্রতি তাঁদের আবেগ কিছু কম ছিল না। সেই সময় এ’বঙ্গের মানুষেরাও একজনের সঙ্গে আরেকজনের দেখা হলে ‘জয় বাংলা' বলে সম্বোধন করতেন। শেষে বহু আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের পরে বাংলাদেশ হল এবং আজ সেই দেশ তার অস্তিত্ব প্রমাণ করে পঞ্চাশ বছরে গর্বের সঙ্গেই নতুনতর উদ্যমে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছে। একটি কথা অকপটে বলা দরকার যে, এই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের উন্নয়নের গতি প্রকৃতির দিকে নজর রাখা ভারতীয় তথা পশ্চিমবঙ্গবাসীর পক্ষে খুবই জরুরি এই জন্যই যে, ‘প্রতিবেশী ভালো থাকলে নিজেও ভালো থাকা যায়’। এটা শুধু চালু কথা নয়, বরং বাস্তব। আর এটা আমরা ইদানীং খুব টের পাচ্ছি যখন বাংলাদেশের গড় আয় ভারতকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। শিল্পের বিকাশ ঘটছে। যোগাযোগ ব্যাবস্থার উন্নয়নে সাম্প্রতিক যোগ পদ্মা সেতু। ফলে ভারতবর্ষ থেকে বেশ কিছু যোগ্য বাস্তুকার, বৈদ্যুতিন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক যেমন সেখানে চাকুরি করছেন, তেমনি বাণিজ্যের সম্ভবনাও প্রবল বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এই ‘উন্নয়নশীল বাংলাদেশের' বিবর্তনের কথা এই বইটিতে লিখে আমাদের কৌতুহল সাময়িকভাবে নিবৃত্ত করেছেন সেখানকার বহু প্রথম শ্রেণির বিশেষজ্ঞ, গবেষক, শিক্ষকরা। তাঁদের সঙ্গে যোগ্য সংগত করেছেন এই বঙ্গের কিছু বিদগ্ধ লেখক ও গবেষক। পাঠক প্রথমে সূচিপত্রটি দেখলেই এই পুস্তকের ওজন অনুভব করবেন। বইটির মূল উপাদানের মধ্যেই এত সারবস্তু রয়েছে যে তার জন্য প্রকাশককে আর আলাদা করে বিজ্ঞাপনের বয়ান লেখার দরকার নেই। এই বইয়ের সম্পাদনা করেছেন দুই বাংলার দুই কৃতি মানুষ- মোস্তফা হোসেইন ও পার্থপ্রতিম রায়। আমি এঁদের সঙ্গে নির্মাণকর্মে জড়িয়ে থাকা বাকি সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা নিবেদন করলাম।

 

— গণেশ প্রতাপ সিং

 

গ্রন্থ প্রসঙ্গ

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অর্ধশত বছর এবং মুজিববর্ষের সমাপনে এই সংকলন গ্রন্থ দুই বাংলার বর্তমান প্রজন্মের জন্য এক উপহার। এই সংকলনে সচেতনভাবে সেই কালপ্রবাহকে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, আগামীকালের ইতিহাস রচনায় আকর হিসাবে হয়তো থেকে যাবে। এই সংকলনে রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজ-সংস্কৃতির বৃত্ত ছাড়িয়ে মানবেতিহাসের সেই যুগক্ষণকে ধরা হয়েছে, যা বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে বাকি দুনিয়ার কাছে উদাহরণসরূপ চিহ্নিত করে।

উত্তর ঔপনিবেশিক সময়পর্বে দুনিয়াজোড়া মুক্তিকামী মানুষের যে-লড়াই, সেখানে কাল এবং ভূগোলের গণ্ডী পার করে ‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমান স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। তিনি তাঁর কর্মে, আদর্শে আর সাফল্যের কারণেই আজ কিংবা আগামীকালের সংগ্রামী মানুষের প্রেরণা। কারণ তিনি সফল। কারণ উত্তর ঔপনিবেশিক সময়কালে বহু জাতি তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিয়ে যে-লড়াই করে চলেছে, সেখানে গুটিকয়েকের মধ্য অন্যতম সফল বাংলাদেশ, যার রূপকার শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর জীবন, তাঁর আদর্শ, রণকৌশল আজ আক্ষরিক অর্থেই মানবজাতির কাছে অনুশীলনযোগ্য।

বাংলাদেশ গঠনের মূল কারণ, তার প্রয়োগগুলো এই গ্রন্থে বুঝতে চাওয়া হয়েছে বেশ কিছু রাজনৈতিক প্রবন্ধে এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিশিষ্টজনদের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণায়। পঞ্চাশ বছর পার হয়ে মুক্তিযুদ্ধের সেই ন-মাসকে যখন ফিরে দেখা যায়, তখন শাহরিয়ার কবির দ্ব্যর্থহীনভাবে পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাইছেন বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার লড়াইয়ের পশ্চাতভূমি ১৯৬১ সাল। তিনি যুক্তি এবং তথ্য দিয়ে প্রমাণ করেছেন ন-মাসের রক্তক্ষয়ী রণাঙ্গনের পেছনে ছিল জননেতার দীর্ঘ এক দশকের প্রস্তুতি। যখন তিনি মাত্রই একজন ছাত্রনেতা, তাবৎ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যখন জন্মকথায় বাঙালির স্বপ্নপূরণ সম্পন্ন নয়, চাই এক স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র, নতুন রাষ্ট্রের জন্মে উদ্‌বেলিত, তখনকার তাঁর সেই মন্তব্য— পাকিস্তানের জন্মকথায় বাঙালির স্বপ্নপূরণ সম্ভব নয়, চাই স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র, যেখানে জাতপাত-ধর্ম নিশানে মানুষ-মানুষের বৈরি নয়। শাহরিয়ার কবির তাঁর মতকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে পাঠাকদের স্মরণ করিয়ে দেন কোনও যুগপুরুষের জন্ম তাৎক্ষণিক নয়; বরং তার পেছনে থাকে দীর্ঘকালের এক ইতিহাস।

যে-গণতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতাকে আদর্শ মেনে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ রাষ্ট্র গড়তে চেয়েছিলেন, সেই রাষ্ট্রব্যবস্থাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে একনায়কের প্রবেশ ঘটে। ঘাপটি মেরে থাকা ঘাতকবাহিনীর জন্য উন্মুক্ত হয় রাজপথ, রাজসম্মান এবং বহু কিছু। অবস্থা এমনই হতাশার যে, সংখ্যায় এবং বিদেশিশক্তির সমর্থনে তারাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশের রক্ষক এবং ভক্ষক। আজ তারা যে সমূলে উৎপাটিত এমনটা নয়। সেটা সম্ভবও নয়। তবে শিক্ষিত এবং যুক্তিবাদী মানুষ যদি সর্তক থাকে, তবে বহু ক্ষেত্রেই জাতির পক্ষে বিপজ্জনক এমন শক্তি বশে থাকে— তা কেবল নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে নয়, ব্যবহারিক জীবনযাপনের মধ্যে দিয়েও সেই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হয়। সেই অভিশপ্ত ১৫ অগস্টকে স্মরণ করে বর্তমান প্রজন্মকে এই সতর্কতাবাণীই শোনানো হয়েছে। বলা বাহুল্য, ঘাতকদের অনেকেই এখনও বিবিধ আইনি জটিলতার কারণে শাস্তি এড়িয়ে আত্মগোপনে; বিবরে লুকিয়ে তারা এখনও প্রত্যাঘাতের অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর খুনে সেদিন ভারতীয় গণমাধ্যমের কী ভূমিকা ছিল? কেমন ছিল বাকি রাষ্ট্রগুলোর প্রতিক্রিয়া? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি সত্যিই ঘাতকদের সঙ্গে সেদিন হাত মিলিয়ে ছিল? এমন প্রশ্নগুলোর একটা রূপরেখা এই গ্রন্থে পাওয়া যাবে। এই স্পর্শকাতর বিষয় সম্পর্কে বহুলাংশে আবেগের আতিশয্যে অনুত কিছু মন্তব্যও থেকে যায়। তবু বঙ্গবন্ধুর হত্যার নেপথ্য নায়কদের খুঁজে বের করার কাজ এখনও শেষ হয়নি।

১৯৭৬ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনের সময় বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন করে ‘বাঙালি জাতীয়তা’ শব্দযুগল পালটে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তা’ নামে এক নতুন শব্দজোড়কে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সেদিন সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবনায় খোন্দকার আবদুল হামিদ লিখেছিলেন:

‘বাঙালি জাতীয়তা’ কথাটা শুধু রাজনৈতিক দিক থেকে ভ্রান্ত নয়, ঐতিহাসিক দিক থেকেও অবাস্তব। এমনকি রাজনৈতিক দর্শন হিসাবেও এর অসরতা সপ্রমাণিত। ‘বাঙালি জাতীয়তা’ তাই মিসনোমার। আমাদের জাতীয়তাকে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তা’ বলাই অ্যাপ্রোপ্রিয়েট বা সঙ্গত। ...এই জাতির রয়েছে গৌরবময় আত্মপরিচয়, নাম-নিশান-ওয়ারিশী উত্তরাধিকার, ঐতিহ্য-ইতিহাস, ঈমান-আমান, যবান-লিসান, শিল্প-সাহিত্য, স্থাপত্য-সংগীত সবকিছু…

সংবিধান প্রণেতাদের এমন সংশোধনের মধ্যে দিয়ে সেদিন বাঙালি জাতীয়তা থেকে আলাদা হয়ে গড়ে ওঠে বাংলাদেশি জাতীয়তা, যা সামরিক সময়কালে, গণতন্ত্রের অবমূল্যায়নের কালে বাংলাদেশের চালিকাশক্তি হয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ সেদিন সম্পূর্ণ ইউ টার্নে নিম্নগমণে চলে গিয়েছিল, আজকের বাংলাদেশের মর্মের মধ্যে তা কীভাবে যে দৃঢ়মূল হল, সেটাই বুঝতে চাওয়া হয়েছে এই সংকলনে।

স্বাধীনতার প্রয়োজনে বিদেশি রাষ্ট্রের সহযোগিতা অস্বীকৃত নয়। বিশেষত সেই বিদেশ যদি পড়শি দেশ হয়। আজকের প্রজন্ম জানে না, মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে কেমনভাবে দুই বাংলা মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। ঋত্বিককুমার ঘটক তাঁর যুক্তি তক্কো আর গপ্পো সিনেমায় সেদিনের জনউন্মাদনার একটা ডকুমেন্ট রচনা করে গেছেন। আগ্রহীরা তা দেখলে বুঝতে পারবেন আজ বাংলাদেশ জুড়ে যে ভারত বিদ্বেষ, পশ্চিমবঙ্গ বিদ্বেষ, তা কতটা অসূয়াজনিত ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া, আর কতটাই-বা তা যুক্তিপূর্ণ। এই গ্রন্থ-সংকলনটিতে সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান জানাচ্ছে দুই দেশের মধ্যে কেমন ছিল সম্পর্ক সমীকরণ। তেমন আবার দীর্ঘ অন্ধকার পার হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেদিনের ভারতীয় সামরিক বাহিনীকে সম্মান প্রদর্শনের উজ্জ্বল প্রচেষ্টার বিবরণও এখানে লিপিবদ্ধ হল।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে, দেশে সামরিক শাসন জারি করে স্বাধীনতার স্বপ্নকে লুণ্ঠন করতে যারা চেয়েছিল, আশার কথা তারা আজ ইতিহাসের আবর্জনা। ফলে যে ইউ-টার্নের কথা কিছু আগে এসেছিল, সেখান থেকে ফের একটা টার্ন নিয়েছে বাংলাদেশ, যে-টার্ন উন্নয়নের বাংলাদেশ-অর্থনীতি আর শিক্ষার আলোয় যেখানে রেখাচিত্র উর্ধমুখী। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন আমাদের কাছে মস্ত এক আশার আলো। এই সংকলনে তারও কিছু হদিস দেওয়া হয়েছে

বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্ম তিনটে সমাজে ভাগ হয়ে গেছে। প্রথম ভাগে যারা, তারা ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত এবং অধিকাংশই বিদেশরত। ইদের সময় ছাড়া দেশের কথা তাদের খুব একটা মনে থাকে না। এরা সমাজের অগ্রগামী অংশ, মেধা-বুদ্ধিতে তারা উন্নত, অথচ দেশের জনকল্যাণে তাদের কোনও ভূমিকা নেই। দ্বিতীয় ভাগে যারা আছে, তাদের ব্যক্তিগত আয় বেড়েছে, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি জীবনযাপনের মান এক ইঞ্চিও বাড়েনি। তারা অনুকরণ আর সস্তার বিনোদনে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। ভুলেই গেছে তাদের বাপ-দাদারা একদিন আপন রক্তে ধান ক্ষেত রঞ্জিত করেছিলেন বলেই আজ তারা স্বাধীনতার স্বাদ পাচ্ছে। তৃতীয় ভাগে হতদরিদ্র এক জনগোষ্ঠী, যারা ধর্মপ্রভুদের হাতের পুতুল। তাদের না-আছে ব্যক্তি স্বাধীনতা। না মর্যাদা। অথচ এদের জন্যই বঙ্গবন্ধু, এদের জন্যই মুক্তিযুদ্ধ। এদের জন্য পাকিস্তানের উপনিবেশিকতা থেকে মুক্তি লাভ।

এই সংকলন গ্রন্থে পশ্চিমবঙ্গ থেকে তিনটে লেখা সংযোজন করা হয়েছে। হয়তো এই কারণে যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কেবল বাংলাদেশের নয়-বাংলাভাষী সব মানুষের, সব কালের। পশ্চিমের অংশগ্রহণ কিছু কম নয়।

Comments


bottom of page